বাংলাদেশের শারিয়াকরণ : সুদে ও আসলে গুনতে হবে কি দেনা ?
বিডি নিউজে প্রকাশিত নিবন্ধ https://bangla.bdnews24.com/opinion/47440 - 04 May 2017 সংক্ষেপিত:-
বিখ্যাত জরিপ-সংগঠন PEW ২০১৩ সালের এপ্রিলে কিছু মুসলিম দেশে শারিয়ার প্রতি সমর্থন জরীপ করে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে - "The World’s Muslims: Religion, Politics and Society". (বিশ্বমুসলিম: ধর্ম, রাজনীতি ও সমাজ)। তাতে দেখা গেছে বাংলাদেশে:-
সাধারণ মুসলিমদের মধ্যে শারিয়া আইনকে আল্লাহ'র আইন মনে করেন ৬৫%, (পাকিস্তান ৮১%), শারিয়া আইন একটাই, বিভিন্ন নয় মনে করেন ৫৭%, (পাকিস্তান ৬১%), দেশে শারিয়া আইন চান ৮২%, (পাকিস্তান ৮৪%),
শারিয়া সমর্থক মুসলিমদের মধ্যে ব্যাভিচারীকে প্রস্তরাঘাতে মৃত্যুদণ্ড সমর্থন করেন ৫৫%, মুরতাদ অর্থাৎ ইসলাম-ত্যাগীদের মৃত্যুদণ্ড সমর্থন করেন ৪৪%, (পাকিস্তান ৭৬% ।
দেশে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যবসা, দ্রব্যমূল্য সর্বত্র নৈরাজ্য, রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন ও দুর্নীতিবাজদের দাপট সহ সমাজের সর্বক্ষেত্রে অসহ্য অরাজকতার কারণে গণতন্ত্র বদনাম হবে এবং "ইসলামী রাষ্ট্রতত্ত্ব" জনপ্রিয় হবে এটাই স্বাভাবিক। এখন বহু সাধারণ লোক কোনো মওলানা মুফতির হুকুম-ফতোয়া ছাড়াই নিজে থেকে শারিয়া প্রয়োগকারী হয়ে গেছেন। লক্ষ্যনীয়, এই সাধারণ লোকগুলো র অনেকেই কিন্তু কোনো ইসলামী দল করেন না। উদাহরণ:-
- আগে রোজার মধ্যে হোটেলগুলো চাদর দিয়ে ঢাকা থাকত। অমুসলিমেরা তো বটেই কোন কোন মুসলমানও বাইরে খেত। এখন রোজার মধ্যে বাইরে কাউকে খেতে দেখলে সাধারণ মানুষের একাংশ হিংস্র হয়ে ওঠে। গাড়িতে ভ্যাপসা গরমের দুপুরে এক যাত্রী পানি খেয়েছে বলে ড্রাইভার বাস থামিয়ে তাকে অপমান করে নামিয়ে দিয়ে চলে গেছে।
- গ্রামে নানা-নানীর কোলে মানুষ, এখন ঢাকায় থাকেন এমন একজনের কন্যার আকিকা। তিনি তাঁর প্রিয় নানা নানীকে গ্রাম থেকে আনার আয়োজন করেছেন, এদিকে উৎসবের সাত দিন আগে নানা মারা গেলেন। তখন গ্রামের সাধারণ মানুষ এসে দাবী করল শারিয়া মোতাবেক নানী চার মাস ঘরে থাকবে, নিজের নাতির বাসা হলেও ঢাকায় যেতে পারবে না।
- এক গ্রামে নববর্ষের উৎসবে এক কিশোর এক কিশোরীর সাথে হ্যাণ্ডশেক করেছে বলে গ্রামবাসী তাকে বেধড়ক পিটিয়েছে কোনো মওলানার ফতোয়া ছাড়াই।
- পঙ্গু হয়ে কয়েক বছর শয্যাগত থাকার পর একজনের মৃত্যু হলে সাধারণ মানুষ দাবী করেছে কাফফারা না দিলে তাঁর জানাজা হবে না কারণ তিনি এত বছর নামাজ পড়েননি।
- কোনো এক কলেজের শিক্ষক ছাত্রীদের বোরখা পড়তেবাধ্য করলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও হাইকোর্টকে এগিয়ে আসতে হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় কঠোর নির্দেশ দিয়েছে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কাউকে বোরকা পরতে বাধ্য করা যাবে না - জনকন্ঠ ২৬শ আগস্ট ২০১২।
- রংপুরে এক এস-আই ১৯জন মেয়েকে থানায় ধরে নিয়ে আসে বোরখা না পড়ে পার্কে গিয়েছিল বলে। সেখানেও কোর্টকে এগিয়ে এসে সেই পুলিশকে তলব করে ও এ ধরণের অপকর্মকে নিষিদ্ধ করে - জনকন্ঠ ০৩ মার্চ ২০১০।
এরকম অজস্র উদাহরণ প্রমাণ করে সাধারণ মানুষের মধ্যে শারিয়া আইন প্রয়োগ করার উগ্র প্রবণতা ধীরে ধীরে বেড়ে যাচ্ছে। এবারে কি পদ্ধতিতে শারিয়াকরণটা হচ্ছে তা দেখা যাক।
- দেশে মাদ্রাসার সংখ্যা কমপক্ষে তিন লাখ – (জনকন্ঠ ১৫ মে ২০১৩ - মুনতাসীর মামুন)। এগুলোর প্রায় সবাই শারিয়া আইনে বিশ্বাস করে ও ছাত্রদের সেই শিক্ষা দেয়। এগুলো থেকে প্রতি বছর সমাজে আসছে লক্ষ লক্ষ শারিয়া-সমর্থক যারা সমাজের প্রতি স্তরে তাদের প্রভাব খাটাতে থাকে। শারিয়াপন্থী মওলানা-মুফতিরা এখন এক নিমেষে বহু হাজার যুদ্ধংদেহী তরুণকে রাস্তায় নামানোর প্রচণ্ড ষ্ট্রীট পাওয়ারের অধিকারী। ৫ই এপ্রিল ২০১৩ শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের লক্ষ লোকের সমাবেশ তার প্রমাণ। এ বাহিনী আগামীতে অনেক বাড়বে এবং সর্বত্র এর চাপ অনুভুত হবে। এ চাপ ঠেকানোর পদ্ধতি এখনও বাংলাদেশে অনুপস্থিত। এটা সে দেশেও ঘটেছিলো, সেখানেও এ চাপ ঠেকানোর পদ্ধতি অনুপস্থিত ছিল।
- অসংখ্য মওলানা-মুফতি নিয়ে দেশজুড়ে শারিয়া-সমর্থক আলেম সমাজ গড়ে উঠেছে। জনগনের ওপর এঁদের প্রভাব প্রচণ্ড। এঁদের অনেকেই অত্যন্ত উগ্র ও আপত্তিকর ভাষায় হুংকার দিয়ে বক্তৃতা করেন, কারো কাছে এঁদের জবাবদিহিতা নেই।
- তাঁদের অসংখ্য কর্মতৎপর ও ধনী সংগঠন জাতির চোখের সামনে শুধুমাত্র তাঁদেরই ইসলামি ব্যাখ্যা ধরে রেখেছে। তার বিপক্ষে সুফী ইসলামী বা ইসলামের অরাজনৈতিক ধর্মতত্বের বইগুলো লেখা ও প্রচারের সংগঠন নেই বললেই চলে।
- তাঁদের আছে দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান মসজিদ, জনতাকে প্রভাবিত করার সুযোগ যা তাঁরা পুরোটাই নিয়েছেন এবং ভবিষ্যতেও নেবেন।
- তাঁদের আছে দলীয় পত্রিকা এবং সেগুলোতে ক্রমাগত হচ্ছে শারিয়া প্রচার। পক্ষান্তরে তাঁদের ইসলামী ব্যাখ্যার ভিত্তিহীনতা, কোরাণ-বিরোধীতা, ইসলাম-বিরোধীতা ও নারী বিরোধীতা তুলে ধরার তেমন কোন পত্রিকা নেই। তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ইসলামী দলিল ছাপতে বেশীরভাগ সেকুলার পত্রিকা ভয় পায়।
- এটাও শারিয়াপন্থীদের আরেকটা বিরাট সাফল্য। তাঁরা জনগণ, সরকার, মিডিয়া, টিভি-রেডিয়ো-সংবাদপত্র প্রকাশনা সহ সারা জাতিকে ভয় পাওয়াতে সক্ষম হয়েছেন। এটা আরো বাড়বে বৈ কমবে না।
- তাঁদের আছে দুনিয়া জুড়ে ফেইথ-কাজিন সংগঠগুলোর সাথে শক্তিশালী আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক। পক্ষান্তরে আমাদের বুদ্ধিজীবি ও সুশীল সমাজ ভোগেন অহংরোগ, গর্ব, একগুঁয়েমী, ও সাংগঠনিক ব্যর্থতায়। টাকার জোর বা আন্তর্জাতিক সমন্বয়ও তাঁদের নেই।
- ২০০৬ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারী ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনষ্টিটিউট-এ জামাত ঘোষণা দিয়েছে দেশ জুড়ে মহাশারিয়া কোর্টের জটাজাল বানানো হবে। গ্রাম থাকবে উপজেলার নিয়ন্ত্রনে, উপজেলা থাকবে জেলার নিয়ন্ত্রনে, এভাবে হাজার হাজার শারিয়া-কোর্টের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ থাকবে বায়তুল মোকাররমের খতিবের হাতে। জামাত যদি সত্যিই তা করতে পারে তবে জাতি শারিয়া কোর্টের জটাজালে মাছের মতো আটকে যাবে। তাঁরা "আইন", "কোর্ট" এসব শব্দ এড়িয়ে এমন নাম দেবেন যে এটাকে আইন দিয়ে ধরা যাবেনা।
- ইসলামী টিভি চ্যানেল গুলো তো আছেই, অন্যান্য প্রায় প্রতিটি টিভি চ্যানেলে ইসলামী প্রোগ্রাম চলে। প্রায় প্রতিটি সংবাদপত্রে ইসলামী অংশ থাকে যার প্রত্যেকটিইশারিয়াপন্থী। জনগনের ওপরে এসবের প্রভাব সুস্পষ্ট।
- দাবী এসেছে ন্যাশন্যাল ফতোয়া বোর্ড গঠনের।
- বায়তুল মুকাররমের খতিবকে প্রধান বিচারপতির মর্যাদা দিতে হবে এ দাবী বহু আগে থেকেই ছিল।
ঘটনা যেভাবে ঘটছে তাতে একদিন গণতান্ত্রিক ভোটেই বাংলাদেশ শারিয়া রাষ্ট্র হয়ে যেতে পারে যেমন মিসরে ঘটেছে। আমাদের কিছুটা দেরী হয়েছে কিন্তু উপায় এখনো আছে। তা হলো, জাতিকে শারিয়া সম্পর্কে শিক্ষিত করে তোলা। জাতিকে জানানো যে হানাফী ও শাফি আইনের কেতাবে প্রত্যেকটিতে যে ছয় হাজারের বেশী আইন আছে তার বেশীর ভাগই ভালো কিন্তু কিছু আইন লঙ্ঘন করে কোরান, রসূল (স), ও মানবাধিকার। সেগুলো যুগোপযোগী করতেই হবে। সব মিলিয়ে, শারিয়া আইনের সিংহভাগ মানুষের তৈরী।
- আরো উচিত দুনিয়ার অন্যতম বৃহৎ ইসলামী সংগঠন নাহদলাতুল উলামা'র "ইসলামী রাষ্ট্রের বিভ্রম" (The Illusion of An Islamic State) বইটার বাংলা অনুবাদ করে জাতির কাছে পৌঁছে দেয়া। ২০০৩ সালে এ সংগঠনের সদস্য ছিল মোটামুটি চার কোটি, এর প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট হাজী আবদুর রহমান ওয়াহিদ ছিলেন পৃথিবীর বৃহত্তম মুসলিম প্রধান দেশ ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট।
- আরো দরকার ড: বাসাম তিবি, ড: আবদুল্লাহ আন নাঈম-এর মতো শারিয়া-বিরোধী ইসলামী বিশেষজ্ঞদের বইগুলো অনুবাদ করে জাতির কাছে পৌঁছে দেয়া।
- আরো উচিত জাতিকে জানানো কেন ড: হাশিম কামালী'র মতো শারিয়া-বিশেষজ্ঞেরা (তাঁর অসাধারণ গবেষণার বই "প্রিন্সিপলস অফ ইসলামিক জুরিসপ্রুডেন্স") মুসলিম বিশ্বকে শারিয়া আইনের প্রয়োগ সম্পর্কে হুঁশিয়ার করেছেন।
এসবের ভিত্তিতেই বেশ কিছু মুসলিম প্রধান দেশের ইমামেরা শারিয়া-ভিত্তিক ইসলামী ব্যাখ্যাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। ইতিহাস ব্যাকুল হয়ে বারবার হুঁশিয়ারী দিচ্ছে আমাদেরকে, কিন্তু আমরা বিপুল অহংকারে সে হুঁশিয়ারী উপেক্ষা করেই যাচ্ছি, করেই যাচ্ছি। আমরা বালুর মধ্যে মাথা গুঁজে নিজেদেরকে সান্ত্বনা দিচ্ছি এই বলে যে ঝড়টা আসছে না। দেশেও কিছু কাজ হয়েছে। বই আছে "শারিয়া কি বলে, আমরা কি করি", ডকুমুভি বানানো হয়েছে "নারী", "শারিয়া প্রহেলিকা" ও “হিল্লা"-, নিউইয়র্কবাসী গবেষক বক্তা ও লেখক সজল রোশনের "রিলিজিয়াস মাইন্ডসেট", মহিউদ্দিন আহমদ-এর "ধর্মচিন্তার পুনর্গঠন কেন জরুরী", এই ধরণের বই দিয়ে গণসচেতনতা সৃষ্টি করা জরুরী। এখন আমাদের দায়িত্ব এগুলো ছড়িয়ে দেয়া।