হাসান মাহমুদ - 11 June 2021- https://opinion.bdnews24.com/bangla/archives/66579 (বিডি নিউজের নিবন্ধের সম্পাদিত সংস্করণ):-
সূরা হুজরাত আয়াত ১০ মেনে চললে ফিলিস্তীনে মুসলিম রক্তস্রোতের বিরুদ্ধে মধ্যপ্রাচ্যের তৈল-সম্রাটদেরই বলিষ্ঠ দাঁড়ানোর কথা। রসূলও (স) বলেছেন “মুমিনদের পরস্পরের ভালোবাসা, হৃদ্যতা ও আন্তরিকতার উদাহরণ একটি দেহের মতো। যখন ইহার কোনো অঙ্গ ব্যাথা পায় তখন সারা দেহ নিদ্রাহীনতা ও জ্বরগ্রস্ত হইয়া ব্যাথা পায়" - সহি মুসলিম ৬২৫৮, সহি বুখারী ৮ম খন্ড ৪০ ইত্যাদি।
কিন্তু তাঁরা ফিলিস্তীনদের রক্তস্রোতে মোটেই "নিদ্রাহীনতা ও জ্বরগ্রস্ত হইয়া ব্যাথা" পাচ্ছেন না, তাঁরা বরং ইসরায়েলের সাথে নব নব রাজনৈতিক অনুরাগে উৎফুল্ল। ওদিকে সৌদি বোমায় ধ্বংসপ্রাপ্ত মুসলিম দেশ ইয়েমেনের দুর্ভিক্ষে অনেক উদ্বিগ্ন অমুসলিম সংগঠন "নিদ্রাহীনতা"-য় ভুগে বিশ্ববাসীর কাছে চাঁদা ভিক্ষে করে বেড়াচ্ছে।
*********************
ইসরাইল-সমর্থক মুসলিম-বিদ্বেষী এক শক্তিশালী ইহুদী চক্র প্রবলভাবে প্রভাবান্বিত করছে আমেরিকার সরকার ও সংবাদমাধ্যম। এর মধ্যে আছে - চিনে রাখুন- আমেরিকায় ব্রিজিটি গ্যাব্রিয়েল, পামেলা গ্যালার, রবার্ট স্পেনসার, ডেভিড ইয়েরুসালমী, রেমন্ড ইব্রাহীম-এর দল এবং Geert Wilders- এর মত ইউরোপের কিছু রাজনীতিবিদ। সেই সাথে ড. জন এসপোসিটো, নান ক্যারেন আর্মস্ট্রং-এর মতো অনেক বিখ্যাত মুসলিম-বান্ধব অমুসলিম স্কলারেরা রয়েছেন।
**********************************
১৯৩৪ সালে লণ্ডন থেকে ভারতে ফিরে জিন্নাহ মৃতপ্রায় অল ইণ্ডিয়া মুসলিম লীগকে চাঙ্গা করতে ভারত ভ্রমণের অংশ হিসেবে বাংলায় আসেন। বাংলায় তখন ফজলুল হকের বিপুল জনপ্রিয় বিশাল কৃষক-প্রজা পার্টি, প্রতিদ্বন্দ্বী খাজা-গজাদের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র "ইউনাইটেড মুসলিম পার্টি" আর কলকাতায় হাসান ইস্পাহানী সাহেবের "নিউ মুসলিম মজলিস"। কৃষক-প্রজা পার্টিকে বাংলা থেকে বের করে সর্বভারতীয় অঙ্গনে আনা দরকার, তাই নেতাদের সাথে জিন্নাহর আলোচনা চলছিল। কিন্তু একদিন তিনি "ইউনাইটেড মুসলিম পার্টি"-র খাজা নাজিমুদ্দীনের সাথেও কথা বলাতে কৃষক-প্রজা পার্টির নেতারা খাপ্পা হলে জিন্নাহ বলেছিলেন ভারতের বিন্দু বিন্দু মুসলিম শক্তিকে একত্রিত না করলে তিনি জয়ী হবেন না।
এটাই মূল কথা, বিশ্বময় ছড়ানো ছিটানো মুসলিম বান্ধব শক্তিগুলোকে একত্রিত করে ইসরাইলের মোকাবিলা করা। বিশ্বে ফিলিস্তনের শত্রুরা সামরিক শক্তিশালী কিন্তু সংখ্যায় কম। ফিলিস্তীনের বন্ধুরা সামরিক দুর্বল কিন্তু তাদের সংখ্যা অগণিত। সংখ্যাও একটা পরাক্রান্ত শক্তি, বিশ্বময় ছড়ানো ছিটানো এই ইসরাইল-বিরোধী ফিলিস্তিন-বান্ধব শক্তিকে একত্রিত করলেই দানব দমন করা যাবে। কাজটা রাজনৈতিক ও মুসলিম বিশ্বের নেতাদের। উদাহরণ অজস্র।
1. ২০২১ - ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ফেটে পড়েছে কোটি কোটি মানুষ উত্তর থেকে দক্ষিণ মেরু, নিউইয়র্ক থেকে মাদ্রিদ, কেপটাউন থেকে বাগদাদ, বার্লিন, ফ্রাঙ্কফুর্ট, লাইপজিগ, স্টুটগ্রার্ট, মিউনিখ, হামবুর্গ, কোলন, হ্যানোভার ও হিল্ডেসহাইম শহরে, লণ্ডনে, ফ্রান্সের প্যারিসে, লিওঁ, বোর্দো, মার্সেইসহ অন্যান্য শহরে, কোপেনহেগেনে, সিডনি ও মেলবোর্নে, টোকিওতে। আমি যেখানে থাকি সেই টরন্টোতে "প্যালেষ্টাইনের সমর্থনে ইয়ং-ডানডাস স্কয়ার লোকে পরিপূর্ন হইয়া গিয়াছিল, জনতা ইসরাইল কনসুলেটের দিকে অগ্রসর হইয়াছিল" - সিবিসি নিউজ ২২ মে ২০২১।
2. ২০২৪ সালে নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্ররা গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন বিরোধী বিক্ষোভ শুরু করে যা সরকারের বিরোধিতা পরাস্ত করে দাবানলের অবিশ্বাস্য দ্রুততায় সারাদেশে এবং পরে ইউরোপের ইউনিভার্সিটিগুলোতে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
3. ০৭ই জানুয়ারী ২০০৯ প্যালেস্টাইনে গণহত্যার বিরুদ্ধে টরন্টোতে ইহুদী মহিলারা ইসরায়েলী দূতাবাসে ঝটিকা প্রবেশ করে চীৎকার করে অবস্থান ধর্মঘট করেছিল, তাদের হাতে পোষ্টার ছিল -‘‘হে ফিলিস্তিনীরা, আমরা তোমাদের সাথে আছি’’। পরে পুলিশ ডেকে তাদের জোর করে বের করে দেয়া হয়।
4. আমেরিকান মুসলিমেরা (জনগণের মাত্র ১+% ) আতংকে পড়েছিল ২০০১ সালে নিউইয়র্কে টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পর। কারণ ক্রূদ্ধ ৯৯-% অমুসলিমের একাংশও যদি অস্ত্রহাতে মুসলিমদের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাহলে কেয়ামত হয়ে যাবে। তখন কি করেছিল সাধারণ অমুসলিম জনগণ? শোনা যাক এক বাঙালী আমেরিকানের কাছ থেকে, সংক্ষেপে :-
“নর্থ ফার্ষ্ট ষ্ট্রীটে ঘুরতেই চোখে পড়ল গাছপালার আড়ালে পুলিশের গাড়ী। পুলিশ কর্ডন করে রেখেছে পুরো মসজিদ এলাকা। আমরা নামাজ পড়লাম নির্বিঘ্নে। বিস্মিত হয়েছিলাম মসজিদের লবিতে বিশাল ফুলের তোড়া দেখে, সাথে চিরকুটে লেখা ছিল - ‘‘আমরা তোমাদের প্রতিবেশী, তোমাদের শুভাকাংখী, অতিতের মত আগামীতেও আমরা পাশাপাশি থাকব শান্তির সাথে”। ওই তিনদিনে প্রায় পঞ্চাশটা মেসেজ রেকর্ড হয়েছিল মসজিদের টেলিফোনে। তার একটা ছিল চরম বিদ্বেষময় অশ্লীল গালিতে পুর্ণ, করিৎকর্মা পুলিশ দ্রুত ধরে জেলে পুরেছিল মেসেজদাতা যুবককে। বাকি উনপঞ্চাশটা মেসেজগুলোর মূল কথাই ছিল ভ্রাতৃত্ব, বন্ধুত্ব আর সহযোগিতার আগ্রহ। এমনকি কোন কোন ম্যাসেজে এমনও বলা হয়েছিল যে, ‘‘যদি তোমরা দোকানে-বাজারে যেতে ভয় পাও তবে সংকোচ না করে আমাদেরকে বলো, আমরা করে দেব তোমাদের হাট-বাজার’’- জনপ্রিয় "নতুন দেশ" পত্রিকা, ঈদসংখ্যা, ০৮ই সেপ্টেম্বরে ২০১০। পত্রিকা কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ এমন আশাব্যঞ্জক বিবৃতি প্রকাশের জন্য।
ভুললে চলবে না এই দেশগুলোতে অমুসলিমরা আমাদের চেয়ে বহুগুণে বেশি এবং এদের উল্লেখযোগ্য অংশ নাস্তিক। কিন্তু তাদের কাছে পৌঁছেছে নজরুলের মহান বাণী:-
"হিন্দু না ওরা মুসলিম? ঐ জিজ্ঞাসে কোনজন? কান্ডারী বলো ডুবিছে মানুষ - সন্তান মোর মা'র" ! অর্থাৎ মরছে আমারই ভাইবোন !
তাদের কাছে বিষয়টা মুসলিম-অমুসলিমের নয়, দানবের হাতে মানবের রক্ত ঝরছে সেটাই সবচেয়ে বড়ো কথা। আমাদের একাত্তরের মতো হামাসও মুক্তিযোদ্ধার দল, তাকে তো ইসরাইল-সমর্থক গোষ্ঠী "সন্ত্রাসী" ঘোষণা করবেই। একই অপশক্তি নেতাজী সুভাষকে জাতিসংঘের “ওয়ার ক্রিমিন্যাল” তালিকায় যোগ করে রেখেছে, কোনো ভারতীয় সরকার এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়নি।
5. ২০০৫ সালে রসূল (স)-এর কুখ্যাত ড্যানিশ কার্টুনের বিরুদ্ধে তৎক্ষণাৎ গর্জে উঠেছিলেন ফ্রান্সের সর্বোচ্চ ইহুদী ধর্মনেতা রাবাই জোসেফ সিটরুক:- ‘‘কার্টুন প্রকাশের পরে বিশ্ব-মুসলিমের যে ক্রোধ তাহাকে আমি সম্পুর্ণ সমর্থন করি। কোন ধর্মকে অপমান করিয়া কেহই কিছু লাভ করিতে পারে না, ইহা অত্যন্ত অসৎ কর্ম’’। গর্জে উঠেছিলেন ক্যালগেরী’র সর্বোচ্চ ইহুদী ধর্মনেতা রাবাই নেলসন-ও। Rabai Joseph Sitruk:-
6. ইমাম সাবির আলির বিখ্যাত 'LET THE QURAN SPEAK' চ্যানেলে ইসরাইলের বিরুদ্ধে সোচ্চার ১৯৩৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ইহুদী রাবাইদের সংগঠন Neturei Karta (নেটুরি কার্টা) নেতা রাবাই Yisroel Dovid Weiss-এর সাক্ষাৎকার:- https://www.youtube.com/watch?v=uAWQvN1f0Q0
7. "বিশেষ করিয়া রাজনৈতিক ইহুদীবাদ ও ইহুদী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য ১৯৪২ সালে ইহুদী সংগঠন ‘আমেরিকান কাউন্সিল ফর জুডাইজম’ প্রতিষ্ঠিত হয় (“An organization specifically created to fight against both Zionism and a Jewish state)”।
কি মনে হয় ?
8. ইংল্যাণ্ডে লেবার পার্টির ইহুদী সাংসদ জেরাল্ড কফম্যান দাবী করেছিলেন গাজাতে ইসরায়েল (হিটলারের) নাৎসী পার্টির মতো নিষ্ঠূরতা করছে, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অস্ত্র-অবরোধ (Arms embargo) প্রয়োগ করা হোক- সিএনএন ১৬ জানুয়ারী ২০০৯।
9. ইসরাইলের ভিতর কমিউনিস্ট পার্টি 'মাকি' এবং 'হাদাস' জনতার সাথে রাস্তায় এবং সাংসদ হিসাবে পার্লামেন্টে তীব্র লড়াই করে চলেছে প্যালেস্টাইনের পক্ষে। পার্লামেন্টে সাংসদ আয়মান ওডেহ্-র তীব্র চিৎকার - "নেতানিয়াহু, তুমি সিরিয়াল কিলার"!! :- https://www.facebook.com/100009085376629/videos/1842300553199003
এরাই আমাদের মিত্র !!
*****************************************
RELATED:- গণতন্ত্র ইসলামবিরোধী? পশ্চিমা বিশ্ব ইসলাম-মুসলিমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে ?? https://hasanmahmud.com/index.php/articles/islamic-bangla/338-ganatantra-isalamabirodhi-pascima-bisba-isalama-musalimera-biruddhe-yuddha-ghosana-kareche-mithya-dabi