শেখ মুজিবকে যেমন দেখেছি - একটি ব্যক্তিগত খতিয়ান - হাসান মাহমুদ বিজয় দিবস ১৬ই ডিসেম্বর ২০২৪
মুক্তিযুদ্ধ একাত্তরে হঠাৎ আকাশ থেকে পড়েনি, তার একটা ঘটনাবহুল প্রস্তুতিপর্ব আছে। সেই উত্তাল বছরগুলোতে (1964 - 1970) ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা হিসেবে আমি তাঁকে এভাবেই দেখেছি, এখানে ভিন্নমতের অবকাশ আছে।
**************************
তাঁর তীব্র বিরোধীরা তাঁর সম্পর্কে কি বলেছেন ?
- “মধ্য ষাট দশক থেকে একাত্তর পর্যন্ত মুজিব ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের অবিসম্বাদিত নেতা……..তাঁর অবস্থান ছিল ১৯৪৬ সালে জিন্নাহর মতো” - The Political History of Muslim Bengal: An Unfinished Battle of Faith – "দৈনিক আমার দেশ"-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ড. মাহমুদুর রহমান, ৪র্থ অধ্যায় পৃষ্টা ১৩১ - (এটা ইন্টারনেটে এক বক্তা বলেছেন। আমি তাঁকে নির্ভরযোগ্য মনে করি, কিন্তু কেউ এই তথ্যের সত্যায়ন করলে ভালো হয়)।
- “শেখ হাসিনা জাতির পিতার কন্যা” - জীবনে যা দেখলাম ৯ম খন্ড পৃষ্ঠা ১২৫ - জামাতের আমীর গোলাম আজম।বইটা জামাত ও শিবিরের অনলাইন লাইব্রেরী থেকে ফ্রী ডাউনলোড:- https://shibircloud.com/pdf/jibone_ja_dekhlam_9.pdf
কোন মুক্তিযুদ্ধ শুধুমাত্র সম্মুখ সমরে হয় না। একাত্তরে কিছু লোক ছাড়া বাকি সমস্ত জাতি যুদ্ধ করেছে - যে নৌকায় ভারত থেকে মুক্তিযোদ্ধারা গোপনে অস্ত্র এনেছিল তার মাঝিও মৃত্যুঝুঁকি নিয়েছিল যদিও সে সম্মুখ সমরে যুদ্ধ করেনি। তাই "মুক্তিযোদ্ধা"-কে সংজ্ঞায়িত করা কঠিন। তাজউদ্দিনের নেতৃত্বে প্রবাসী স্বাধীন সরকারের তত্ত্বাবধানে মুক্তিযুদ্ধের এগারোটি সামরিক ফ্রন্টের সাথে আরো দুটো বেসামরিক ফ্রন্ট ছিল - কূটনৈতিক (বিভিন্ন দেশে আমাদের হাই কমিশনার অ্যাম্বাসেডর এম্বাসির অফিসার ইত্যাদি), এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র যা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের মহা উদ্দীপক শক্তি এবং যা ছাড়া মুক্তিযুদ্ধ কল্পনাই করা যায় না।
মুক্তিযুদ্ধ একাত্তরে হঠাৎ আকাশ থেকে পড়েনি, তার কয়েক বছরের একটা ঘটনাবহুল প্রস্তুতিপর্ব আছে। সেই উত্তাল বছরগুলোতে ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা হিসেবে (1964 - 1970) আমি তাঁর বিস্ফোরিত নেতৃত্বে জাতিকে জেগে উঠতে দেখেছি। তিনি এক অত্যাচারিত শোষিত জাতির দুর্দান্ত বলিষ্ঠ নেতা যাঁকে সারা বিশ্ব প্রতিটি মুহূর্ত সসম্ভ্রমে নিরীক্ষণ করেছে। বছরের পর বছর অক্লান্ত তিনি দুর্দম সাইক্লোনের মত একের পর এক বক্তৃতায় সারাদেশ ছুটে বেড়িয়েছিলেন। জেল থেকে জামিনে মুক্তি, আবার বন্দী, আবার জামিনের চক্রে এক অবিশ্বাস্য ঘূর্ণাবর্ত সৃষ্টি করেছিলেন তিনি। পাকিস্তানি ট্যাঙ্ক কামান বন্দুকের বিরুদ্ধে তিনি আমাদের আত্মিক শক্তিকে অপ্রতিরোধ্যভাবে যেভাবে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন সেখানেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন বিশ্বে একমাত্র "পোয়েট অফ পলিটিক্স"।
সব মিলিয়ে তিনিই মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদিত স্রষ্টাপুরুষ।
কে বলেছে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অনুপস্থিত ছিলেন? আমরা কি শুনিনি "মৃত জিয়া জীবিত জিয়ার চেয়ে শক্তিশালী"? এরই নাম "বিমুর্ত উপস্থিতি" যা মূর্তিমান উপস্থিতির চেয়ে বহুগুণ বেশি শক্তিশালী। মুক্তিযুদ্ধটা হয়ে-ই ছিল তাঁর আকাশ ছোঁয়া সুবিশাল ভাবমূর্তি সামনে রেখে। সেই অগ্নিগর্ভ দিনগুলোতে দেশের প্রতি ইঞ্চি মাটি-পানি-জঙ্গলে, শহরে বন্দরে গ্রামে - জাতির মানস-জগতে তাঁর সর্বগ্রাসী উপস্থিতি হিমালয়ের মত অভ্রভেদী ছিল প্রতিটি মুহূর্তে।
তাঁর মঙ্গল কামনায় অজস্র মানুষ নফল রোজা রেখেছে - দিনে রাতে দোয়া করেছে এবং হজ্বে গিয়েও দোয়া করেছে। বিশ্বের আর কোন রাজনৈতিক নেতার কল্যাণে স্রষ্টার ইবাদত করেছে মানুষ?
২৫শে মার্চ পাক আর্মি হঠাৎ গণহত্যা শুরু না করলে হয়তো মুক্তিযুদ্ধ হতো না, হয়তো পাকিস্তানের কাঠামোতেই আমরা আমেরিকা কানাডা ভারতের মতো পূবে পশ্চিমে এক পাকিস্তানের দুটো প্রদেশ হয়ে থাকতাম। কিন্তু আমাদের মধ্যে তিনি এমন প্রবল আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি করেছিলেন যে সেক্ষেত্রেও আমাদেরকে শোষণ করার শক্তি পশ্চিম পাকিস্তানের হতোনা। সেখানেই জাতির বড় একটা অংশ তাঁকে সম্মানে আদরে রাজনৈতিক পিতার আসনে বসিয়েছিল এ আমার স্বচক্ষে দেখা অভিজ্ঞতা। জাতির সেই সুগভীর আবেগকে আইন করে জাতির ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে তাঁকে ছোট করে আনা হয়েছে, বিরক্তি সৃষ্টি করা হয়েছে। "এক জাতি এক নেতা" করে শুধু তাঁরই নয় বরং জাতিরও প্রভূত ক্ষতি করা হয়েছে।
আমরা যেন কখনো না ভুলি, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ মানুষের ইতিহাসে একমাত্র যুদ্ধ যেখানে সর্বোচ্চ নেতা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত শত্রুর হাতে বন্দী কিন্তু যুদ্ধে বিজয় হয়েছে। সেই পরাক্রান্ত শত্রুকে বিধ্বস্ত করে, ঘরে বাইরে অসংখ্য ষড়যন্ত্রের উত্তাল তরঙ্গের মধ্যে আমাদের স্বাধীনতার নাওটাকে কুলে ভেড়ানোর মত অবিশ্বাস্য সাফল্যই শুধু নয়, নেতাকে শত্রুর কারাগার থেকে মুক্ত করে এনে জাতিকে কে উপহার দিয়েছিলেন?
তিনিই তাজউদ্দিন আহমদ। রাজনৈতিক জীবনের চিরসঙ্গী সেই তাজউদ্দিনকে মন্ত্রীসভা থেকে, নিজের পাশ থেকে সরিয়ে দিয়ে বঙ্গবন্ধু নিজেকেই দুর্বল করেছিলেন।
স্বাধীনতার পর সেই মহানায়কের চরিত্র বদল দেখে আমরা স্তম্ভিত হয়ে গেছি। বিভিন্ন অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষতিকর ঘোষণা যেমন "কোথায় আজ সিরাজ শিকদার", "লালঘোড়া দাবড়ায়ে দেব", রক্ষী বাহিনীর তাণ্ডব, নিজেকে ইমপিচমেন্ট বা অভিশংসনের (আইনানুগ পদ্ধতিতে অপসারণ করা) ঊর্ধ্বে ঘোষণা করা, এগুলো স্বাধীনতার আগের সেই অভ্রভেদী নেতার সাথে খাপ খায় না।চতুর্দিকে লুটপাট এবং বিশেষ করে ঢাকা রেডক্রসের প্রধান গোলাম মোস্তফার রিলিফের কম্বল চুরির কথা দুনিয়া জানে। সেই ক্রিমিন্যালদেরকে শাস্তি না দিয়ে যখন তিনি বলেছেন "আমার রিলিফের কম্বল কোথায়", "লোকে পায় সোনার খনি আমি পেয়েছি চোরের খনি" - তখন ক্রিমিন্যালদের মনোবল বেড়েছে, আমরা হতাশ হয়েছি।
সাফল্য-ব্যর্থতা সব শাসকের মতো তাঁরও আছে। তাঁর বাকশালকে নিন্দা বা প্রশংসা করার সুযোগ নেই কারণ ওটা প্রয়োগের আগেই তিনি নিহত হয়েছেন। তবে সবারই অধিকার ছিল বাকশালে যোগ দেবার, নেতা হবার। তাছাড়া একদলীয় রাষ্ট্র নতুন কিছু নয়, চীনসহ অনেক দেশ ওই ব্যবস্থায় ভালোই করছে। হয়তো ওটাতেই আমাদের ভালো হতো, কে জানে!!
আমার মাঝে মাঝে মনে হয় আমাদের মতো মহা দুর্নীতিবাজ, কূটবুদ্ধি, ষড়যন্ত্রী, চরম অনৈতিক ও হিংস্র দলবাজির জাতি গণতন্ত্রের উপযুক্তই নয় !
কে জানে, হয়তো এমন দেশে "সবাই যোগ দিতে পারবে" এমন একদলীয় ব্যবস্থাই শ্রেষ্ঠ !!
আমার চিরকালই মনে হয়েছে বাহাত্তরের ১০ই জানুয়ারী দেশে ফিরে তিনি যদি তাজউদ্দিনকে বলতেন – ‘তুমি নেতৃত্ব দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছো - কার মাথায় কি পোকা ঘুরছে তুমি আমার চেয়ে ভালো জানো। আমি চললাম কক্সবাজারে বাংলো বানিয়ে থাকবো, তুমি একটা সর্বদলীয় সরকার বানিয়ে দেশ চালাও - দরকার হলে আমাকে ডেকো’।
সেটা হলে আমাদেরকে হয়তো আজকের এই দুঃসহ দিন দেখতে হতো না।